আবদুর রহমান, টেকনাফ::
কক্সবাজারের টেকনাফে সাগরপথে মানবপাচারকারীরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠছে। সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে গত এক সপ্তাহে টেকনাফের বিভিন্ন স্থান থেকে নারী ও শিশুসহ ২৯ জনকে আটক করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৩৮ জন যাত্রী নিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সেন্টমার্টিনের কাছে একটি ট্রলার ডুবে যায়। এ ঘটনায় ২১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মারা যান অনেক বাংলাদেশি। সে সময় টেকনাফ উপকূলের নোয়াখালীপাড়ার কাটাবনিয়া-কচুবনিয়া ঘাট ‘মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট’ নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। সম্প্রতি আবারও এ পথে মানবপাচার বেড়ে গেছে।
জানা যায়, ১১ ফেব্রুয়ারি সেন্টমার্টিনের কাছে ডুবে যাওয়া ওই ট্রলারের ১৩৮ জন যাত্রীর মধ্যে ৭৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ৪৪ জন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। ওই ঘটনায় ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে কোস্টগার্ডের দায়ের করা মামলায় এখন পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, পাচারকারী চক্রের প্রলোভনে পড়ে রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি শিথিল হলে পাচার আবারও বেড়ে যাবে।
টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলী বলেন, ‘গত কয়েক দিনে আটকের সংখ্যাই বলে দিচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। তাদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ক্যাম্পগুলোতে টহলও বাড়ানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এই চক্রের প্রলোভনের শিকার হয়েই অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন আটক হওয়া রোহিঙ্গারা। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই টেকনাফ উপকূল হয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।’
রাতে বেড়েছে গাড়ির আনাগোনা
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাত গভীর হলেই টেকনাফ-উখিয়া সড়কে সন্দেহজনক গাড়ির আনাগোনা বেড়ে যায়। সন্ধ্যার পরপরই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এনজিও এবং প্রশাসনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে তখন সক্রিয় হয়ে ওঠে অপরাধী চক্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে এসব গাড়িতে চলে মানবপাচার। নারী ও শিশুরাই প্রধান টার্গেট। নীরবে পাচারকারীরা সাগরপথে মানবপাচার চালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা শিবির থেকে পাচার হওয়া মেয়েদের অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় যৌনকর্মীতে। ছেলেশিশুদের বাধ্য করা হয় বিভিন্ন শ্রমে। মালয়েশিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং ভারত ও নেপালেও তাদের পাচার করা হয়।
ক্যাম্পে পাচারকারীরা সক্রিয়
গত কয়েক দিনে আটক মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মো. ওসমান, আবদুল গফুর ও সাইফুল মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। তারা উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা। এছাড়া উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা মানবপাচারকারী সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযুক্তরা হলেন—হাফেজ ছলিম, আতাত উদ্দিন, মোহাম্মদ আলম, আবদুর করিম, হাফেজ মোহাম্মদ আইয়ুব, আবদুল করিম, মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মোহাম্মদ কবির, আমির হোসেন, মোহাম্মদ ফয়েজ, নূর হোছন, মোহাম্মদ নাগু, নুরুল কবির, আবুল কালাম, লাল বেলাল, দিল মোহাম্মদ, মোহাম্মদ ফারুক, জোবাইর হোসেন, লালু মাঝি, আলী আকবর, ইমাম হোসেন ও শুক্কুর। মোহাম্মদ ছলিম, লম্বা কবির, মোহাম্মদ শাহর বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও এলাকায় তারা পাচারে তৎপর রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
পুরনো রুটেই পাচার
২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে এক হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আটক করেন। পাচারকারীদের খপ্পরে পড়া বাংলাদেশিদের অনেকেই ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় পথেই মারা যান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ওই ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করে। বেশিরভাগই টেকনাফ উপকূলের কাটাবনিয়া-কচুবনিয়া ঘাট দিয়ে মালয়েশিয়ায় যেতো। সে সময় স্থানীয়দের কাছে ওই এলাকা ‘মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট’ নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। পরে আন্তর্জাতিক চাপে মানবপাচার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অভিযানে নামে এবং জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে। এতে সাগরপথে মানবপাচার শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। তবে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর নতুন করে এই রুটেই আবারও মানবপাচারের চেষ্টা চালাচ্ছে দালালরা।
পাচারের পয়েন্ট
টেকনাফের সাগর তীরবর্তী কয়েকটি এলাকার পাশাপাশি কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বেশে কিছু পয়েন্ট দিয়ে মানবপাচারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাচারকারীরা। এরমধ্যে কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছটা, ফিশারিঘাট, নাজিরাটেক, সমিতিপাড়া; মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, কুতুবজোম, ধলঘাটা; উখিয়ার সোনারপাড়া, রেজুরখাল, ইনানী, ছেপটখালী, মনখালী; টেকনাফের বাহারছড়া, নোয়াখালী, শাহপরীরদ্বীপ, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, হাদুরছড়া, জাহাজপুরা, কচ্ছপিয়া, শামলাপুর সদরের ঈদগাঁও, খুরুশকুল, চৌফলণ্ডী, পিএমখালী, চকরিয়া, পেকুয়া; চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা ও পটিয়া উল্লেখযোগ্য।
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে দেড় হাজারের বেশি আশ্রয়প্রার্থী বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়েছে; যা ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে সাগর পাড়ি দেওয়া মানুষের তুলনায় প্রায় ৫০ গুণ বেশি। ২০১৫ সালের সাগরযাত্রীদের বেশিরভাগই ছিল পুরুষ, কিন্তু ২০১৮ সালের যাত্রীদের শতকরা ৫৯ ভাগই নারী ও শিশু।
অভিযানের পরও পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য কমেনি উল্লেখ করে টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এই মৌসুম কম দুর্যোগপ্রবণ বলে পাচারকারীরা প্রচারণা চালাচ্ছে। তাই এ সময়ই রোহিঙ্গারা সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া যাত্রা করছেন। তিনি আরও বলেন, ‘যাদের আত্মীয়-স্বজন বিভিন্নভাবে মালয়েশিয়া গেছেন, তাদের মধ্যেই সে দেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। অনিশ্চিত জীবন থেকে মুক্তির আশায় সেখানে পালিয়ে যাচ্ছেন তারা। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছেন।
র্যাব-১৫, সিপিসি-১ টেকনাফ ক্যাম্পের কোম্পনি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট মির্জা শাহেদ মাহতাব বলেন, ‘সাগরপথে মানবপাচারে জড়িতদের ধরতে র্যাবের একটি টিম কাজ করছে। পাশাপাশি ক্যাম্পে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। দ্রুত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
প্রাণহানির পরও মানবপাচার থামছে না এমন অভিযোগের বিষয়ে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘হঠাৎ করে রোহিঙ্গা পাচার বেড়ে যাওয়ায় আমরাও একটু চিন্তিত। তবে উপকূল এলাকার পাচার শুধু পুলিশের পক্ষে রোধ করা সম্ভব নয়। মানবপাচার রোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তবে আমরাও সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের মহাসচিব এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরেই আমরা দেখছি, মাঠপর্যায়ের পাচারকারী বা দালালদের আইনের আওতায় আনা বা ক্রসফায়ারের নামে মারা হচ্ছে। কিন্তু তাদের গডফাদারদের ব্যাপারে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের দালালদের ধরপাকড় বা মেরে লাভ হবে না। এই চক্রটির সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীদের পাকড়াও করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তবেই পাচার স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে।
পাঠকের মতামত: